ঘুম (বিশ্রাম) কেন জরুরি?

যে দিনে ঘুমায় রাত জাগে, তার রোগ সবার আগে!

সৃষ্টিকর্তা মানুষকে কষ্টসহিষ্ণু ও পরিশ্রম-নির্ভর করে তৈরি করেছেন [সূত্র : সূরা বালাদ; আয়াত নং ৩-৪]। তিনি মানুষের ওপরে এমন কিছু চাপিয়েও দেননি- যা তার সাধ্যের অতীত। মানব-সন্তান অনেক কিছু করে দেখাতে পারে, কিন্তু অবশ্যই একটানা নয়। কাজের (পরিশ্রম) ফাঁকে ফাঁকে তাকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিয়ে মস্তিষ্ককে পুনরায় কার্যক্ষম করে তুলতে হয়।
মানব-মস্তিষ্ক কেবলমাত্র তখনি প্রয়োজনীয় রিচার্জড হয়- যখন মানুষটা ঘুমিয়ে থাকে। কিন্তু ঘুম কম হলে বা কম ঘুমালে মস্তিষ্ক ঠিকমতো শক্তি-সঞ্চয় করতে পারে না। এমনটা যখন দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ঘটতে থাকে, তখনি মানবদেহ অকালে অসুস্থ বা রোগাাক্রান্ত হয়ে পড়ে। মানবদেহের সুস্থতা সুনিশ্চিত করার জন্য প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ন্যূনতম সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুম দরকার। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ আজকাল একে তো সময়মতো ঘুমায় না, তার ওপরে যতক্ষণ এবং যেভাবে ঘুমানো দরকার, তাতেও ঘাটতি থেকে যায়।
ঘুম পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ওষুধ!
শরীরে তীব্র ব্যথায় চিৎকাররত কোনো রোগীকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে প্রথমেই রোগীকে ব্যথানাশক তথা চেতনানাশক ইঞ্জেকশন পুশ করা হয়; সঙ্গে থাকে ঘুমের ওষুধ। কিছুক্ষণ বাদেই রোগী আর ব্যথা অনুভব করেন না এবং গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়েন। রোগীকে তখন ভর্তি করে রেখে বলা হয় : ৭২ ঘণ্টা পার না হলে কিছুই বলা যাচ্ছে না!
কেন এভাবে জরুরি রোগীর চিকিৎসা শুরু করা হয়, জানেন? কারণ ঘুম পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ওষুধ! যে কোনো অসুস্থ মানুষকে শুধুমাত্র ঘুমানোর সুযোগ তৈরি করে দিলেই অসুস্থতার প্রাথমিক ধকল অনেকাংশে কাটিয়ে উঠতে পারে।
ঘুম কী?
নিদ্রা বা ঘুম হচ্ছে শরীরের (বিশেষত স্নায়ুতন্ত্রের) সাময়িক বিশ্রামের অবস্থা। দিনভর ব্যস্ত কর্মযজ্ঞের পর ঘুম আমাদেরকে পুনঃকর্মক্ষম করে তোলে। বিশ্রামের মাধ্যমে শরীর আবার সক্রিয় তথা কাজ করার শক্তি ফিরে পায়। এ কারণে তৃপ্তিদায়ক ঘুমের পর সবারই কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। বলা যায়, নিদ্রা শারীরিক শক্তি পুনরুদ্ধার করে। ঘুমন্ত অবস্থায় হৃৎপিণ্ডের গতি, রক্তচাপ, শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি, পাকস্থলীর হজম ক্ষমতা সবকিছুই হ্রাস পায়। কারো কারো মতে, ওই সময় মস্তিষ্কের কিছু কিছু অংশে রক্ত সঞ্চালন কমে আসে। আবার কেউ বলেন, জাগ্রত অবস্থায় নিদ্রা আনয়নকারী বস্তু সঞ্চিত হতে থাকে, যার প্রভাবে পরে ঘুম চলে আসে।
মস্তিষ্কের বিশেষ এলাকায় সজাগ থাকার কেন্দ্র রয়েছে- যেখানে উত্তেজক অনুভূতি ক্রমাগত আক্রমণ করে। যতক্ষণ পর্যন্ত এই কেন্দ্র সক্রিয় থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষ জেগে থাকতে পারে। কিন্তু বিশ্রাম নেওয়ার প্রস্তুতি নিলে উত্তেজক অনুভূতির আক্রমণ কমতে থাকে। সেই সঙ্গে অন্ধকার ও শান্ত পরিবেশ পেলে স্নায়ুতন্ত্রের উত্তেজনা আরো কমে যায় এবং মানুষটি গভীর ঘুমে অচেতন হয়।
ঘুমানোর সময় মানুষের চোখ দু’টি বন্ধ থাকে বলে আলোক-জ্ঞান লোপ পায়। বিজ্ঞানীরা বলেন, ঘুমালে সর্বপ্রথম ইচ্ছাশক্তি লোপ পায় আর জেগে ওঠার পর সবার শেষে ফিরে আসে স্মরণশক্তি। মস্তিষ্কের যে অংশ শরীরের নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করে, তা দেরিতে লোপ পায়, তবে বুদ্ধিবৃত্তিক ও বিশেষ জ্ঞানগুলোর আগেই সেই ক্ষমতা আবার ফিরে আসে। নিদ্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্ক এবং নিদ্রায় সবচেয়ে বেশি উপকৃতও হয় মস্তিষ্ক।
ঘুমের মধ্যে আমাদের শরীরের সকল দেহকোষ কাজ করার মতো প্রাণশক্তি ফিরে পায়, কোথাও সমস্যা থাকলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা মেরামত হয়। নার্ভ-এর ক্লান্তি দূর হয় এবং খাদ্য হজমে সহায়তা করে। রক্ত চলাচলের মাত্রা সঠিক রেখে মানসিক প্রশান্তি ফিরে আসতে সাহায্য করে, চামড়াকে সতেজ রাখে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় (এজন্যই জরুরি রোগীদেরকে হাসপাতালের বিছানায় ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখে শরীরকে তার সক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়)।
বয়সভেদে নিদ্রার প্রয়োজনের তারতম্য হতে পারে। যুবা বয়সের মানুষ সহজেই ঘুমিয়ে পড়ে, কিন্তু বয়স যত বাড়ে, ঘুম আসতে দেরি (সমস্যা) হয়। নিবিড় পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, মানুষের ঘুমের বিভিন্ন স্তর ও পরিমাপ রয়েছে। বেশিরভাগ মানুষ ঘুমের মধ্যে নড়াচড়া করেন। ঘুমন্ত ব্যক্তি সাধারণত ২০-২৫বার শরীরের অবস্থান পরিবর্তন করেন (এজন্য বিছানা বড়ো হওয়া প্রয়োজন)।
আজকালকার ব্যস্ত নাগরিক জীবনে ঘুম সবচাইতে উপেক্ষিত বিষয়গুলোর একটি। অনেকে ব্যস্ততা আর দায়িত্বের চাপে কুলিয়ে উঠতে না পারলে ঘুম মেরে-কেটে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। কেননা তারা মনে করেন- দিনে আটঘণ্টা ঘুমিয়ে কাটানো মানে জীবনের তিনভাগের একভাগ অলস কাটিয়ে দেওয়া। কিন্তু ভাবনাটা মোটেও ঠিক নয়। কেউ মাত্রাতিরিক্ত জেগে থাকার চেষ্টা করলে একপর্যায়ে ঘুমের কোলে ঢলে পড়তে বাধ্য হবেন। গবেষকেরা বলছেন : কম ঘুম আপনার ডায়বেটিস, স্ট্রোক অথবা হৃদরোগের কারণ হতে পারে। ন্যূনতম ছয়ঘণ্টার কম ঘুম এসব রোগে মৃত্যুঝুঁকি ১২% বাড়িয়ে দেয়!
ছয় ঘণ্টার কম ঘুমালে শরীরের যেসব ক্ষতি হতে পারে
প্রতিদিন রাতে ছয় ঘণ্টার কম সময় ঘুমালে শরীরের একাধিক ক্ষতি হয়। এই পরিস্থিতি দীর্ঘদিন চলতে থাকলে এক পর্যায়ে তা মানুষের আয়ুর ওপর প্রভাব ফেলে। একাধিক গবেষণায় বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে ছয় ঘণ্টা বা তার কম সময় ঘুমালে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা ও কোলেস্ট্রেরল বৃদ্ধির মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
আমেরিকান কলেজ অব কার্ডিওলোজি জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছয় ঘণ্টার কম ঘুমালে বা বারবার ঘুমের মধ্যে জেগে যাওয়ার কারণে ধমনীতে এক ধরনের চর্বিজাতীয় প্রাচীর তৈরির আশঙ্কা রয়েছে। ইউএসডিএ হিউম্যান নিউট্রেশন বিভাগের পরিচালক হোসে অরদোভাস বলেন, আগের গবেষণাগুলোতে কম ঘুমালে সরাসরি করোনারি হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার কথা বলা হতো। কিন্তু সা¤প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে- কম ঘুম সরাসরি হার্টের ওপর নয়, তবে শরীরে অ্যাথারোক্লেরোসিস সৃষ্টিতে ভ‚মিকা রাখে।
অ্যাথারোক্লেরোসিস এমন একটি রোগ যেখানে শরীরের ধমনীর মধ্যে প্রাচীর তৈরি হয়। সাধারণত চর্বি, কোলেস্ট্রেরল, ক্যালসিয়াম এবং অন্যান্য উপাদানের সমন্বয়ে ধমনীর মধ্যে এই প্রাচীর তৈরি হয়। মূলত হৃৎপিণ্ড থেকে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত শরীরের বিভিন্ন অংশে পরিবহনের কাজ করে এই ধমনী। তাই ছয়ঘণ্টার কম ঘুমালে বিজ্ঞানীরা ধমনীতে যে প্রাচীর তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করছেন- সেটি মানুষের জীবনে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। এই ধরনের প্রাচীরের কারণে ধমনী আগের তুলনায় অনেকটাই সংকুচিত হয়ে যাবে যা রক্ত সঞ্চালনে বাধার সৃষ্টি করবে।
ধমনীতে প্রাচীর তৈরির ফলে রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি হলে তা স্ট্রোক, হজমে সমস্যা, স্থূলতা, ব্যাথা এমনকি হৃদরোগের কারণ হতে পারে।
কোনো অবস্থাতেই রাত জাগবেন না
পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে বলা হয়েছে : রাতকে সৃষ্টি করা হয়েছে বিশ্রাম তথা ঘুমের জন্য আর দিবাভাগ কাজ (পরিশ্রম)-এর জন্য [সূত্র- ২৫:৪৭, ২৭:৮৬, ২৮:৭৩, ৩০:২৩, ৪০:৬১, ৭৮:৯-১১]। প্রবাদ আছে- early to bed early to rise, makes a man healthy and wise. চিকিৎসকেরাও বলেন- যে দিনে ঘুমায় আর রাতে জাগে, তার রোগ সবার আগে! কিন্তু আমরা আজকাল প্রায় পুরো রাত জেগে অন্তর্জালে অহেতুক সময়ক্ষেপণ করি; ফলস্বরূপ ভোরবেলা ঘুম থেকে জাগতে পারি না। ‘ভোরের হাওয়া হাজার রোগের দাওয়া’- এটা জানার পরও সেই সুফল থেকে বঞ্চিত হই!
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জরুরি প্রয়োজনে দু’-একদিন রাত জাগতে হতেই পারে। কিন্তু ক্রমাগত রাত জাগলে যে কোনো মানুষের দেহঘড়িতে মারাত্মক গোলযোগ শুরু হয়ে যেতে পারে। যার পরিণতিতে শুরু হয় স্লিপ ডিজঅর্ডার এবং পরবর্তীতে অপরিণত বয়সে হদরোগ ও বিষণ্নতায় আক্রান্ত হতে পারেন। গবেষণায় দেখা গেছে, বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মধারাকেও শ্লথ করে তোলে টানা রাত্রি জাগরণ। সৃজনশীলতা, প্রাণবন্ততা ও কর্মতৎপরতা কমে যায়। অন্যদিকে স্বাভাবিক জৈব-ছন্দ অনুসারে নিয়মিত ঘুম ও বিশ্রাম হলে স্মৃতিশক্তি হয়ে ওঠে সংহত এবং প্রয়োজনের সময় চমৎকার কাজ করে।
প্রত্যেক মানুষের শরীরেই আছে একটি প্রাকৃতিক জৈবঘড়ি- যা কিনা হরমোন প্রবাহসহ যাবতীয় শারীরবৃত্তীয় কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ করে। প্রাকৃতিক নিয়ম হলো : দিনে কাজ করে রাতটাকে রাখতে হবে তৃপ্তিময় সুখনিদ্রার জন্য। কিন্তু জৈব-ছন্দকে যখন দিনের পর দিন প্রাকৃতিক নিয়ম থেকে বিচ্যুত করা হয়, তখনি দেহঘড়িতে বেঁধে যায় গোলমাল। ফলে ক্রমাগত দুর্বল হতে থাকে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা।
মানবদেহে বিভিন্ন হরমোন ও এনজাইমগুলো নিঃসরণের মাত্রা সকাল-সন্ধ্যা ভেদে তারতম্য ঘটে। যেমন কর্টিসোল মানবদেহের শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রমে অত্যন্ত প্রভাব বিস্তারকারী একটি হরমোন। দিনের প্রথমার্ধে এটি সর্বোচ্চ মাত্রায় নিঃসরিত হলেও ক্রমশ কমতে থাকে। কিন্তু টানা রাত্রি জাগরণের কুপ্রভাবে এই প্রাকৃতিক নিয়ম হেরফের হয়ে যায়। বিঘ্নিত হয় স্বাভাবিক হরমোন প্রবাহ। কেউ কেউ বলেন- ক্রমাগত রাত জাগলে কোনো সমস্যা হয় না, অভ্যাস হয়ে (সয়ে) গেছে। এর বিপরীতে গবেষকেরা বলছেন, মদ্যপরাও তো বলে- আমার কোনো সমস্যা হয় না, বরং কিছুটা পান করলেই চনমনে থাকি। এই কথা বলে মদ্যপান করলে কি কলিজার ক্ষতি কম হয়? নিশ্চয় না। একইভাবে রাত জাগার ফলে শরীরের যা ক্ষতি হওয়ার তা ঠিকই হবে।
রাত জাগা মানেই স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ানো
রাত জাগার বদলে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে ভোরে উঠে পড়লে বেশি সুখী ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে পারবেন। রাত যত জাগবেন, দেহের স্বাভাবিক জৈবছন্দ তত ব্যহত হবে। মেলাটোনিন ও কর্টিসোল হরমোন নিঃসরণ বাধাগ্রস্থ হবে। মাঝরাতের পর ঘুমাতে যাওয়া মানে হৃৎপিণ্ডের রক্তনালীর প্রসারণ ক্ষমতা কমিয়ে ফেলা। এর সঙ্গে ক্যান্সারেরও যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। Night owls may face higher heart risk শীর্ষক প্রতিবেনটি ২০০৯ সালের মার্চ মাসে এবিসি নিউজ-এ প্রকাশিত হয়।
যোগশাস্ত্র অনুযায়ী, সূর্যের গতিবিধি পরিপাকতন্ত্রকে প্রভাবিত করে। মানব পরিপাকতন্ত্র সবচেয়ে ভালো কাজ করে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত (শুধুমাত্র এই কারণে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা সূর্যাস্ত থেকে পরের দিন সূর্যোদয় পর্যন্ত পানাহারে বিরত থাকেন)। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত যত গভীর হয়, খাবারকে হজম করার মতো প্রয়োজনীয় এনজাইমগুলোর নিঃসরণের পরিমাণ ততই কমতে থাকে। সে কারণে রাতে দেরি করে খেলে খাবারটা ঠিকমতো হজম হয় না। যারা নিয়মিত রাত জাগেন, হজমযন্ত্রে গোলমাল তাদের জন্য পড়সসড়হ সমস্যা। অন্যদিকে সন্ধ্যা রাতে খাবার খেয়ে দু’ঘণ্টা বাদে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লে পরিপাকতন্ত্র থাকে সুস্থ এবং ওজন থাকে নিয়ন্ত্রণে।
সবকিছু বিবেচনা করে স্বাস্থ্য গবেষকেরা বলছেন, ছন্দময় মনোদৈহিক সুস্বাস্থ্য ও গতিময় কর্মব্যস্ত জীবনের জন্য প্রতিরাতে পরিমিত ঘুমান। তাতে আপনিই সারাদিন কর্মতৎপর থাকবেন এবং হবেন চটপটে, সৃজনশীল ও তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী। অতীব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো- মধ্যরাতের আগের দুইঘণ্টা ঘুম মাঝরাতের পরের চারঘণ্টা ঘুমের চাইতেও মানবদেহের জন্য বেশি উপকারী। জীবনভর সুস্থতার স্বাদ উপভোগ করতে চাইলে ভ্রান্ত লাইফস্টাইল পরিত্যাগ করে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনধারায় ফিরে আসতেই হবে।
ঘুমানোর প্রস্তুতি
আপনি কোথায় ঘুমাচ্ছেন, তার ওপর নির্ভর করছে ঘুম কতটা ভালো হবে। তরুণেরা সাধারণত সোফা কিংবা যেখানে-সেখানে ঘুমিয়ে যান, এমন অভ্যাস পরিহার করতে হবে। ভালো ঘুমে শুধু ক্লান্তিই কাটে না, নিজের শক্তি ফিরে আসে- বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। তাই যে ঘরে ঘুমাচ্ছেন, তা যেন একটু ঠান্ডা হয়, সেদিকে খেয়াল রাখুন। ঠান্ডা রুমে ঘুমালে অনিদ্রাজনিত বিভিন্ন সমস্যা এড়ানো যায়। রুমের তাপমাত্রা ১৯ থেকে ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে ঘুম দারুণ হয় বলে মনে করেন ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গ স্কুল অব মেডিসিনের গবেষকেরা। বদ্ধ ঘরে কখনোই ঘুমাবেন না। জানালা খোলা রেখে ঘুমালে রুমের মধ্যে বায়ু চলাচল স্বাভাবিক থাকে।
আমাদের শরীরের বিশেষ ধরনের শারীরবৃত্তীয় চক্রের স্বাভাবিক সঞ্চালনার জন্য অন্ধকার ঘরে ঘুম বেশ কার্যকর। অন্ধকার ঘরে শরীরে মেলাটোনিনের পরিমাণ বেড়ে যায়, যার কারণে সহজেই ঘুমের গভীরে চলে যেতে পারি আমরা। যাঁরা ঘুরতে পছন্দ করেন কিংবা আলোযুক্ত জায়গায় ঘুমান, তাঁরা চোখের ওপর কালো কাপড় ব্যবহারের মাধ্যমে অন্ধকার পরিবেশ তৈরি করতে পারেন। ঘুমের আগের দুইঘণ্টা চেষ্টা করুন কোনো প্রকারে নীল আলোযুক্ত বৈদ্যুতিক ডিভাইস ব্যবহার না করতে। ল্যাপটপ কম্পিউটার কিংবা মুঠোফোনের আলোর উজ্জ্বলতা রাতে কমিয়ে কাজ করার অভ্যাস করুন।
ঘুমের আগে দেহটাকে আরেকটু শীতল করে নিতে পারলে ঘুম গভীর হবে। সেজন্য ঘুমানোর আগে ওজু করে নেওয়ার অভ্যাস করতে পারেন। এটা করলে মহানবী (সা.)-এর একটি সুন্নাহ্ পালন করা হবে। দেহঘড়িকে নিয়মের মধ্যে আনতে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস দিয়েছেন ঘুম বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন-
• শোয়ার জায়গাটা এমন হতে হবে- যেখানে সূর্যের আলো সহজে পৌঁছায়, কিন্তু রাতের বেলা অন্ধকার থাকে।
• প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমানো ও জেগে ওঠার অভ্যাস গড়ে তুলুন। একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিছানায় যাবেন এবং সেটা যেন খুব দেরিতে না হয়।
• সুস্থ লাইফস্টাইলের জন্য যে অভ্যাসগুলো গড়ে তোলা প্রয়োজন, সেগুলো আয়ত্বে আনতে নিজের প্রতি কঠোর হোন। কোনো অবস্থাতেই ঘুমের নির্ধারিত সময়ের সঙ্গে আপোষ করা যাবে না।
• দিনের কাজ দিনের মধ্যেই শেষ করে ফেলতে হবে।
• ঘুমানোর জন্য বিছানায় চলে গেলেও দেখা যায় ১-২ ঘণ্টা আমরা আবার মুঠোফোনের দেড় ইঞ্চি পর্দার জগতে হারিয়ে যাই। কিন্তু ঘুমানোর ঠিক আগ মুহূর্তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। কোনো অবস্থাতেই মুঠোফোন ও ল্যাপটপ মাথার কাছে রেখে ঘুমাবেন না।
• অতিরিক্ত ওজন, ক্যাফেইন, নিকোটিন ও মদ তৃপ্তিময় ঘুমের প্রধান বাধা।
• ঘুমানোর ঠিক আগে আগে ভারী খাদ্যগ্রহণ ঘুমহীনতার কারণ হতে পারে।
• প্রতিদিন ঘুমের আগে মিনিট দশেক ধ্যানের অভ্যাস করতে পারেন।
• আপেল ভিনেগার ও মধু ঘুমের এক ঘণ্টা আগে খেলে অনিদ্রাজনিত রোগ এড়ানো যায়। দুই টেবিল চামচ আপেল ভিনেগার, এক চামচ মধু গরম পানিতে মিশিয়ে নিয়মিত পান করে আর্নল্ড শোয়ার্জেনেগারসহ অনেক তারকা তাঁদের অনিদ্রা কাটিয়েছেন।
• এমন লোকের পাশে ঘুমাবেন না- যারা ঘুমানোর আগে মন্দ কথা বলে!
দ্রুত ঘুমানোর জন্য করণীয়
ঘুমানোর জন্য বিছানায় যাওয়ার আগেই ঝেড়ে ফেলুন মনের যত ভয়, দুশ্চিন্তা, আক্রোশ, এমনকি পরের দিনের কাজের কথাও (বাঁচলে তো কাজ করবেন, নাকি)! তার বদলে ঢিলেঢালা পোশাক পরে হালকা মেডিটেশন অথবা যোগাসনের মাধ্যমে শরীরকে হালকা শিথিল করে নিন। তারপর শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিন। ঘাড়, কাঁধসহ শরীরের সব পেশী শিথিল থাকলে সুখনিদ্রার পথ সুগম হবে। বিশেষ করে ঘুমানোর আগ মুহূর্তে টেলিভিশন দেখা অথবা মুঠোফোনের ছোট্ট স্ত্রিণে দীর্ঘক্ষণ দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা ক্ষতির কারণ।
যেভাবে ঘুমাবেন (শোয়ার ভঙ্গিমা)
২০০৪ সালে ৬৩জন ব্যক্তির ওপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখা যায়- যারা বামপাশে কাত হয়ে ঘুমায়, তারা দুঃস্বপ্ন বেশি দেখে। ডানপাশে কাত হয়ে ঘুমালে স্বপ্ন বেশি মনে থাকে এবং নিরাপত্তার অনুভ‚তি বোধ হয়। কিছু ওয়েবসাইটে বাম কাতে ঘুমানো সুবিধাজনক বলা হলেও বাস্তবতা এটাই যে, বাম কাতে শুলে দেড়-দু’ কেজি ওজনদার কলিজাটি পাকস্থলীর ওপরে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
ব্রিটিশ পত্রিকা ‘দ্য ডেইলি মিরর’-কে Gastroenterologist বিশেষজ্ঞ Dr. John de Caestecker বলেছেন : ডানকাতে ডান হাতটা সুবিধাজনক অবস্থানে রেখে হাঁটু সামান্য ভাজ করে ওপরে টেনে শোবেন। যা কিনা মহানবী (সা.)-এর ১৪০০ বছর আগের নির্দেশনারই অনুরূপ। মহানবী (সা.) বলেছেন : যখন শয্যা গ্রহণের ইচ্ছ করবে, নামাজের ওজুর মতো ওজু করে ডান কাত হয়ে শয়ন করবে। তিনি আরো বলেছেন, ঘুমানোর আগে বলবে- ‘হে আল্লাহ্, আমি আমার মুখমÐল আপনার দিকে ফিরিয়েছি। আপনাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করেছি। জান্নাতেও আপনি ছাড়া কোনো আশ্রয় নেই, আশা নেই। আপনার অবতীর্ণ কিতাবের ওপর ঈমান এনেছি এবং আপনি যে নবীকে পাঠিয়েছেন, তাঁকে বিশ্বাস করেছি।’ ঘুমানোর আগে এগুলো যেন শেষ কথা হয়। তাহলে রাতের বেলা কেউ যদি মারা যায়- সেটা ঈমানের সঙ্গেই মৃত্যু হবে।
কোনো মানুষ যখন ঘুমাতে যায়, সাধারণত উপুড় কিংবা চিৎ হয়ে শোয় অথবা কোনো এক পাশে কাত হয়ে ঘুমায়। প্রশ্ন হলো- কোন অবস্থায় ঘুমালে শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রম সবচেয়ে ভালো অবস্থায় থাকে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেউ যখন উপুড় হয়ে ঘুমায়, তখন তার শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হতে পারে। কেননা তখন সব চাপ বুকের ওপর এসে পড়ে। এভাবে ঘুমালে হৃৎপিণ্ড ভালোভাবে কাজ করতে পারে না, ফলে মস্তিষ্ক খুব দ্রæত ক্লান্ত হয়ে পড়ে- যা বড়ো ধরনের অঘটন ঘটাতে পারে! টাইম ম্যাগাজিনের এক নিবন্ধে বলা হয় : উপুড় হয়ে ঘুমালে ঘুমের মধ্যে হঠাৎ মৃত্যুর আশংকা অনেক বেশি। উপুড় হয়ে শোয়াটা মহানবী (সা.)-এরও অপছন্দ ছিল। একবার তিনি মসজিদে ঘুমন্ত এক ব্যক্তির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। লোকটা তখন উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছিল। মহানবী (সা.) লোকটাকে জাগিয়ে দিয়ে বললেন, উঠে বসো, এটা ঘুমানোর সবচেয়ে বাজে একটা রীতি।
আবার একদম সোজা হয়ে ঘুমানোও ভালো না। কারণ সোজা হয়ে ঘুমালে পিঠের ওপর চাপ পড়ে আর মুখ খুলে যায়। এভাবে ঘুমালে মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে হয়। এতে করে মুখের ভেতরটা শুকিয়ে যেতে পারে এবং নাক ডাকার শব্দ তৈরি হয়। আবার কেউ যদি বাম পাশে কাত হয়ে শোয়, সেটাও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। কারণ বাম পাশে কত হয়ে ঘুমালে হৃপিণ্ডের ওপর চাপ পড়ে এর কার্যক্ষমতা বাধাগ্রস্থ হয়।
ঘুমানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হলো ডান পাশে কাত হয়ে শোয়া। কারণ বাম পাশের ফুসফুস ডান পাশের ফুসফুসের চেয়ে ছোট, ফলে হার্ট খুব সহজেই এটা বহন করতে পারে, আর যকৃৎও ঠিক অবস্থানে থাকে, পাকস্থলী খুব সহজেই এগুলোর ওপর থাকতে পারে। আর এভাবে ঘুমালে পাকস্থলীর খাবার খুব দ্রুত হজম হয়ে যায়। চিকিৎসাবিজ্ঞানও বিষয়টা সমর্থন করে। অভিজ্ঞ চিকিৎসকগণ রোগীদেরকে ডান পাশে কাত হয়ে শোয়ার পরামর্শ দেন।
ভোরে ঘুম থেকে ওঠা
পবিত্র কোরআন দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তে ও খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে উৎসাহিত করছে। ১৭নং সুরা বনী ইসরাইল-এর ৭৮নং আয়াতে ভোরবেলা নামাজ আদায়ের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। মহানবী (সা.) বলেন : ‘ভোরে আমার উম্মতদের ওপর খুব রহমত বর্ষিত হয়। ফজরের দুই রাকাত নামাজ পৃথিবীর মধ্যে যা কিছু আছে, তার সবকিছু থেকে উত্তম।’ তবে তিন সময়ে ঘুমানো থেকে বিরত থাকবেন- ফজরের পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত, আসর থেকে মাগরিব এবং মাগরিব থেকে এশা পর্যন্ত। আর কখনোই মাত্রাতিরিক্ত ঘুমাবেন না, এতে স্মৃতিশক্তি লোপ পায়!
সকালে ঘুম থেকে উঠলে একজন মানুষ অনেক ভাবে উপকৃত হন। সকালের বাতাসে ওজন স্তরে অক্সিজেনের পরিমাণ তুলনামূলক বেশি থাকে। অক্সিজেন মানুষের মনকে প্রফুল্ল করে এবং শরীরের কার্যক্ষমতা ও কাজের গতি বাড়িয়ে দেয়। সূর্য যখন ওঠে তখন সূর্যের রশ্মিতে লাল রঙের প্রাধান্য থাকে। এই অতি লাল রশ্মি মানুষের স্নায়ুকে উৎফুল্ল করে তোলে। এই সময় অতি বেগুনি রশ্মিও থাকে, যা মানুষের ত্বকে ভিটামিন ডি-এর যোগান দেয়।
ভোরে ঘুম থেকে ওঠা মানুষকে দীর্ঘ ঘুম থেকে বিরত রাখে। দীর্ঘ ঘুম কোনোভাবেই উপকারী নয়। একটানা দীর্ঘ ঘুম হৃদরোগের কারণ হতে পারে। ফলে মু’মিন বান্দাগণ সকালে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ আদায়ের মাধ্যমে স্রষ্টার কৃপায় এই জাতীয় ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকে। তাঁদের হৃদয় পূর্ণ থাকে আল্লাহ্’র প্রতি ভালোবাসায়। সেই হৃদয়ে থাকে তৃপ্তি এবং হৃদয় হয় দুঃশ্চিন্তামুক্ত।
মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘তোমাদের কেউ যখন ঘুমাতে যায় তখন শয়তান তার মাথার কাছে তিনটা গিট দিয়ে প্রতিটি গিটে আঘাত করে বলে, সামনে অনেক লম্বা একটা রাত, আরামে ঘুমাও। কিন্তু সেই ব্যক্তি যখন ফজরের সময় ঘুম থেকে উঠে পড়ে, তখন শয়তানের একটা গিট খুলে যায়, যখন সে ওজু করে তখন দ্বিতীয় গিটটাও খুলে যায়, যখন সে নামাজ পড়ে তখন সবগুলো গিট খুলে যায় আর ওই ব্যক্তি অত্যন্ত প্রফুল্লতার সঙ্গে দিনের কার্যক্রম শুরু করে।’
যে সকল মু’মিন বান্দাগণ দ্রুত রাতের নামাজ শেষ করে শুয়ে পড়েন এবং ভোরে ঘুম থেকে উঠে নামাজ আদায় করেন, তাঁদের হৃদয় মন-মেজাজ খুব ফুরফুরে থাকে। তাঁরা অধিক সময় অধিক কাজ করতে পারেন। এর ব্যতিক্রম হলে অলসতায় ভরপুর একটা দিন শুরু হয়।
মহান আল্লাহ সুবহানুতায়ালা বলেন : ‘তোমাদের ঘুম বা নিদ্রাকে করেছি ক্লান্তি দূরকারী। রাতকে করেছি আবরণ। দিনকে করেছি জীবিকা অর্জনের সময়।‘ (সুরা আন-নাবা; আয়াত -৯, ১০ ও ১১)
ঘুমের মাধ্যমে মানুষের প্রশান্তি লাভের পর ঘুম থেকে উঠার সময় মহান আল্লাহ্’র শুকরিয়া আদায় করা উচিত। হাদিস শরীফে এসেছে- আলহামদুলিল্লাহিল্লাজি আহইয়ানা বা’দা মা আমাতানা ওয়া ইলাইহিন নুশুর। (বুখারি)
হযরত হুযাইফা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূল (সা.) যখন ঘুম থেকে জেগে উঠতেন, তখন বলতেন- সমস্ত প্রশংসাই আল্লাহর জন্য। যিনি আমাদেরকে মারার পর জীবিত করেছেন আর তাঁর কাছেই আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে (বুখারি, ৮১৭)। অতঃপর কালিমাতুশ শাহাদাত পড়বেন- ‘আশহাদুআল্লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আব্দুহু ওয়া রাসুলুহু’ (অর্থ : আমাদের সকল ভালো কর্মের প্রশংসা করবো এবং সকল প্রকার মন্দ-কর্মের জন্য আল্লাহর দরবারে সব সময় ক্ষমা চাইবো)। সর্বশক্তিমান আমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করে স্রষ্টার নৈকট্য লাভের যোগ্যতা দান করুন (আমিন)।
ঘুমের প্রকৃত সময় কখন?
এশার নামাজের পর ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ঘুম খুবই উপকারী। এ সময় এক ঘণ্টার ঘুমে তিন ঘণ্টা ঘুমের উপকার পাওয়া যায়। এ সময় পিনিয়াল গ্রন্থি দুটি শর্ত পূরণ সাপেক্ষে মেলাটোনিন হরমোন উৎপন্ন করে- ১. কক্ষটি নিঃশব্দ ও অন্ধকার হতে হবে। ২. পূর্ণভাবে আরামে শায়িত হতে হবে। যদি ঘুম না আসে, তাহলে মেলাটোনিন হরমোন ঘুমাতে সাহায্য করে। এ সময় ঘুমালে শিশুদের শরীরের বৃদ্ধি দ্রুত ঘটে।
রাত ১২টা থেকে ২টা প্রতি ঘণ্টার ঘুমে এক ঘণ্টা ঘুমের উপকার পাওয়া যায়। রাত ২টা থেকে ফজরের নামাজের আগে পর্যন্ত উত্তম সময়- যা মন মানসিকতা ও শরীরকে প্রশান্ত রাখে। এই সময় মুখস্ত করা, আল্লাহকে স্মরণ করা, ইস্তেগফার করার জন্য মন সুস্থির থাকে। এই সময় ঘুমের বিশেষ কোনো উপকারিতা নেই। এ সময় প্রতি তিন ঘণ্টা ঘুমালে এক ঘণ্টা ঘুমের উপকার পাওয়া যায়। আসলে এই সময়ে ঘুমের কোনো বরকত থাকে না, উপরন্তু শরীর নির্জীব, অলস, অবসাদ, মাথাব্যথা, মনঃসংযোগের অভাব দেখা দেয়।
ফজরের পর থেকে সূর্য উঠা পর্যন্ত পিনিয়াল গ্রন্থি অন্য আরেক রকম হরমোন সেরোটোনিয়ম দুটি শর্তে উৎপন্ন করে এবং এটা ফজরের পর থেকে সূর্যোদয় সময়ে উৎপন্ন হয়। শর্ত দুটি হলো- ১. ব্যক্তিটি জাগ্রত থাকতে হবে। ২. হালকা নড়াচড়া থাকতে হবে (like mental exercise)। যেমন এক ব্যক্তি সালাত আদায় করল। এ সময় কুরআন তেলোয়াত স্নায়ুকে উদ্দীপ্ত করে। আত্মাকে প্রশান্ত করে। এ সময় দিনের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর পরিকল্পনা করার জন্য পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায়। সূর্যোদয়ের পর হালকা ব্যায়াম ও শ্রমসাধ্য কাজ শুরু করা ভালো। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, সূর্যোদয়ের আগে ঘুম থেকে জেগে ওঠা মানুষের জীবনীশক্তি ও কোষের সক্রিয়তা বৃদ্ধি করে। এছাড়াও মানুষের উপলব্ধি ও মানসিক সক্ষমতা বাড়ায়।
বয়স ৪০ এর পর থেকে পিনিয়াল গ্রন্থি মেলাটোনিন উৎপাদন কমাতে শুরু করে, এবং বয়স ৫০ এর মধ্যে তা উৎপাদন বন্ধ করে। তখন ব্যক্তি তার আগের সঞ্চয় থেকে বাকী জীবন মেলাটোনিন ব্যবহার করে। কোনো ব্যক্তি যদি অ্যালঝেইমার/ স্মৃতিভষ্ট, উম্মাদ হয়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে সে সারাজীবন দেরিতে ঘুমানোর অভ্যাস ছিল। এ সবই তো বিজ্ঞানের কথা।
জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাসের রুটিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সঙ্গে মিলিয়ে নিন-
ফজরের নামাজের পর আর ঘুম নয়। খানিক হাঁটাহাটি/ব্যয়াম করা যেতে পারে। গোসল করে (রাজার মতো ভরপেট) শুধুমাত্র জীবন্ত খাবার খেয়ে কাজের (রিজিক-এর সন্ধানে) উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ুন। মূল কাজকর্ম চলবে যোহরের নামাজ অব্দি। নামাজের আগে/পরে (দুপুর ১টা থেকে ২টার মধ্যে) খাবেন প্রজার মতো মাঝারি পরিমাণে অর্ধমৃত খাবার।
যোহরের নামাজ ও খাওয়ার পর সময়-সুযোগ থাকলে ক্ষণিকের বিশ্রাম নেওয়া (ঘুমানো) যেতে পারে। তাতে মন আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে, শরীর পূর্ণোদ্যম ফিরে পায়।
দুপুরের খাওয়ার পর কিছুটা সময় বিশ্রাম (ঘুমানো) মহানবী (সা.)-এর সুন্নাহ্। আধুনিক বিজ্ঞান দুপুরের এই ঘুমের উপকারিতা বর্ণনা করেছে। দুপুরের এই ঘুম মানবদেহে রিচার্জের জন্য প্রয়োজন। দুপুরের ঘুম শুধু দিনের বেলায় শরীরের বিশ্রামকে নিশ্চিত করে না, এটা রাতের ঘুমকেও প্রভাবিত করে। ঘুমানোর সময় অনেকে সোজা হয়ে ঘুমায়, আবার কেউ উপুড় হয়ে শোয়, তবে জ্ঞানী ব্যক্তিরা ঘুমান একপাশে কাত হয়ে। মহানবী (সা.) সব সময় ডান পাশে কাত হয়ে পা দু’টো ইষৎ ভাঁজ করে শুতেন; তাঁর ডান হাত থাকত তাঁর গালের নিচে আর মুখটা ফেরানো থাকত কেবলার দিকে। এভাবে শোয়াকে আধুনিক বিজ্ঞানও সবচেয়ে আদর্শিক পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কারণ এভাবে শুলে শরীর সবচেয়ে আরামে বিশ্রাম নিতে পারে।
দিনের মূল কাজকর্ম চলবে আসরের নামাজ পর্যন্ত। আসরের ওয়াক্ত থেকে মাগরিব এবং মাগরিবের ওয়াক্ত থেকে এশার নামাজ পর্যন্ত কোনো অবস্থাতেই ঘুমানো যাবে না! আসরের ওয়াক্ত থেকে মাগরিব পর্যন্ত হালকা কুসুম গরম পানি পান ছাড়া অন্য কোনো ভারী/শক্ত খাদ্যগ্রহণে বিরত/সংযত থাকুন।
দিনের কাজকর্ম আরো কিছু বাকি থাকলে সেটা মাগরিবের নামাজের আগেই শেষ করতে (কাজ না ফুরালে পরের দিনের জন্য তুলে রাখতে) হবে। মাগরিবের নামাজের পর (এশার নামাজের আগে) রাতের শেষ খাবার খেয়ে নিন। সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে খাবেন ভিখারির মতো অল্প পরিমাণে অর্ধমৃত খাবার। এশার নামাজের পর যত দ্রুত সম্ভব ঘুমানোর প্রস্তুতি নিন। বিশেষ/জরুরি প্রয়োজনে অল্প কিছুক্ষণ জেগে থাকলেও যথাসম্ভব মৌনতা অবলম্বন করতে হবে। ঘুমানোর জন্য ঢিলেঢালা আরামদায়ক পোশাক ও মোটামুটি শক্ত বিছানা উত্তম। বিছানায় শোয়ার আগে ওজু করে নিন আর কোনো অবস্থাতেই মুঠোফোন বা টেলিভিশন দেখতে দেখতে ঘুমাতে যাবেন না।
ঘুমানোর আদর্শ সময় এশার নামাজ আদায়ের পর থেকে ভোরে তাহাজ্জুদ পর্যন্ত। এরপর ঘুম থেকে জেগে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে ফজরের প্রস্তুতি নিতে থাকুন। ওই সময় কোরান তেলওয়াত (অর্থ বুঝে পড়লে মেনে চলার প্রবণতা তৈরি হবে), মেডিটেশন/দমচর্চা/প্রাণায়াম করা যেতে পারে। বিভিন্ন শিক্ষামূলক বইও পড়তে পারেন। এককথায় বলা যায় : ফজরের পর ঘুম নয়, এশার পরে নয় জেগে থাকা!
পরিশেষে বলতে চাই- সফলতার জন্য কম ঘুমানো বার্ধক্যের জন্য ভ্রমণ জমিয়ে রাখার মতো। সারারাতের ভালো ঘুম আপনাকে সারাদিন রাখবে প্রাণোচ্ছ¡ল ও উৎফুল্ল। আপনার প্রতিদিনের কাজগুলো হয়ে উঠবে আরো সুন্দর। অন্যদিকে ভোরের নীরবতার মধ্য দিয়ে দিন শুরু করলে জীবনের সমস্যাগুলোকে খুব দ্রুত সমাধানের পথে নিয়ে যেতে সক্ষম হবেন। কোনো এলার্ম ছাড়াই প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠতে পারাটা জীবনের বড়ো সাফল্য। অর্জন করতে পারেন আর না পারেন- এটাই হোক আপনার আগামী দিনগুলোর লক্ষ্য।

Leave a Reply