টেলিমেডিসিন স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন

আজকের আলচ্য বিষয় টেলিমেডিসিনঃ

ড. মো. আবু জাফর সাদেক 

পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষাপটে প্রাথমিক পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবায় সারাবিশ্বে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে টেলিমেডিসিন। বিশেষ এ চিকিৎসা পদ্ধতি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় নতুন দাঁড় উন্মোচন করেছে যার সুফল পাচ্ছে সব শ্রেণির মানুষ। টেলিমেডিসিন ব্যাপারটি কি এবং কেনইবা এটি এত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। টেলিমেডিসিন হল এমন একটি চিকিৎসা ব্যবস্থা যেখানে রোগীকে সশরীরে চিকিৎসকের কাছে উপস্থিত হওয়ার বিপরীতে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক যন্ত্র যেমন- মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ক্যামেরা প্রভৃতি ব্যবহার করে দূর থেকে তার অসুখের ধরন অনুধাবন করে চিকিৎসা দেয়ার পদ্ধতি। অপেক্ষাকৃত কম জটিল রোগে, চিকিৎসা পরবর্তী ফলোআপে, ওষুধের ডোজ সমন্বয় সাধনসহ বেশ কিছু ব্যাপারে এ পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকর এবং বেশ সাশ্রয়ীও বটে। তবে মনে রাখতে হবে টেলিমেডিসিন মূলধারার চিকিৎসা পদ্ধতির বিকল্প নয় বরং তার পরিপূরক মাত্র। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী টেলিমেডিসিন হল healing from a distance অর্থাৎ দূর হতে নিরাময়। এ ব্যবস্থা স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে রোগীকে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট জায়গায় চিকিৎসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি দেয়।

ঠিক কবে প্রথম টেলিমেডিসিন চালু হয়েছিল তা বলা দুষ্কর হলেও ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় ১৯২৪ সালে আমেরিকাতে বিশেষ ধরনের বেতার যন্ত্রের মাধ্যমে দূর থেকে চিকিৎসা দেয়ার পদ্ধতি চালু ছিল। ১৯৪৮ সালে পেনসুলভেনিয়ার চিকিৎসকরা প্রথম একস্থান থেকে অন্য স্থানে মেডিকেল রিপোর্ট প্রদান করতে সক্ষম হয়। পরে কানাডীয় রেডিওলজিস্টরা একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেন যার মাধ্যমে মন্ট্রিল ও তার আশপাশের এলাকায় রেডিওলজি সংক্রান্ত রিপোর্ট বিনিময় করা সম্ভব হয়। ১৯৫৯ সালে নেব্রাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসকরা নিউরোলজিক্যাল পরীক্ষার রিপোর্ট তাদের ক্যাম্পাসে থাকা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সরবরাহ করার জন্য দূরদর্শন যন্ত্র ব্যবহার করে এবং এ প্রক্রিয়াটি ছিল পারস্পরিক আলোচনার সুযোগ সম্পন্ন। তবে বৃহৎ পরিসরে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে টেলিমেডিসিন প্রথম চালু করে আমেরিকার সামরিক বাহিনী। ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে আমেরিকার নাসা, জনস্বাস্থ্য বিভাগ এবং সামরিক বাহিনী টেলিমেডিসিন খাতে ব্যাপক অর্থ ও সময় ব্যয় করে যা আধুনিক টেলিমিডিসিনে ব্যবস্থার গোড়া পত্তন করে। সময়ের আবর্তনে এবং প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনে ধীরে ধীরে টেলিমেডিসিন আধুনিক রূপ লাভ করে।

টেলিমেডিসিনের প্রকারভেদঃ

রিয়েল টাইম টেলিমেডিসিনঃ  এ পদ্ধতির আরেক নাম হল লাইভ টেলিমেডিসিন বা ইন্টারেক্টিভ টেলিমেডিসিন। এখানে রোগী ও ডাক্তার দূরবর্তী অবস্থানে থাকাসত্ত্বেও ইলেকট্রনিক যন্ত্রের মাধ্যমে একে ওপরকে সরাসরি দেখতে ও শুনতে পারে। এখানে রোগী ও ডাক্তার তাদের প্রয়োজনীয় প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইতে পারে। এ প্রক্রিয়ার সবচেয়ে সুবিধা হল রোগীর মানসিক ও শারীরিক ভাষা বোঝার সুযোগ তৎসঙ্গে শারীরিক পর্যবেক্ষণ, মেডিকেল রিপোর্ট মূল্যায়ন এবং অন্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ে সম্যক ধারণা লাভের সুযোগ।

রিমোট পেশেন্ট মনিটরিংঃ  এ পদ্ধতির অন্য নাম সেলফ মনিটরিং বা সেলফ টেস্টিং পদ্ধতি। এ প্রক্রিয়াতে মেডিকেল ডিভাইস ব্যবহার করে রোগী বাসায় বসে তার স্বাস্থ্যের অবস্থা বা ক্লিনিকাল উপসর্গ সম্পর্কে জানতে ও জানাতে পারে। সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী রোগ যেমন- কার্ডিওভাসকুলার ডিসিস, এজমা, ডায়াবেটিস মনিটরিংয়ের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি বেশি ব্যবহৃত হয়। এ পদ্ধতির সুবিধা হলেও এটি সহজ, সাশ্রয়ী এবং রোগীবান্ধব।

স্টোর অ্যান্ড ফরওয়ার্ডঃ এ পদ্ধতির আরেক নাম এসাইনক্রোনাস টেলিমেডিসিন। এখানে রোগী তার সমস্ত মেডিকেল রেকর্ড, প্রয়োজনীয় ছবি, ভিডিও বা অন্য সব তথ্য বিশেষ ব্যবস্থায় ডাক্তারের কাছে প্রেরণ করেন এবং ডাক্তার তার সুবিধামতো সময়ে প্রেরিত ডকুমেন্টের ওপর ভিত্তি করে ব্যবস্থাপত্র দেন। সাধারণত ডার্মাটোলজি, রেডিওলজি এবং প্যাথলজি সংক্রান্ত চিকিৎসায় এ পদ্ধতি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়।

টেলিমেডিসিনের উপকারিতা

নানাদিক বিবেচনায় টেলিমেডিসিনের উপকারী ভূমিকা অনস্বীকার্য। টেলিমেডিসিন একটি অত্যন্ত সাশ্রয়ী চিকিৎসা ব্যবস্থা যেখানে একটি মোবাইল ফোন বা ক্যামেরা সম্পন্ন কম্পিউটার-ই চিকিৎসা উপকরণ হিসেবে যথেষ্ট। এতদসঙ্গে মেডিকেল রেকর্ড সংরক্ষণ এবং নিন্মোক্ত সুবিধাতো আছেই।

যাতায়াত খরচ বা অতিরিক্ত সময় নষ্ট না হওয়াঃ

যেহেতু দূর থেকে চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ থাকে তাই কষ্ট করে চিকিৎসকের চেম্বারে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না এতে করে যাতায়াত খরচ লাগে না এবং চিকিৎসকের সিরিয়াল পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার দরকার হয় না।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা গ্রহণের সুযোগঃ

যেসব দূরবর্তী বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব আছে সেখানকার লোকজন চাইলেই টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে পছন্দমতো বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণের সুযোগ পেতে পারে। এক্ষেত্রে রিয়েল টাইম এবং স্টোর ও ফরওয়ার্ড উভয় পদ্ধতি বেছে নেয়ার সুযোগ থাকছে।

সুবিধামতো সময়ে চিকিৎসা প্রদানঃ

চিকিৎসক চাইলে তার পছন্দমতো সময়ে রোগীর পাঠান ছবি, ভিডিও, মেডিকেল ইতিহাস, টেস্ট এবং অন্য রিপোর্ট পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে পারেন যাতে করে ব্যস্ত চিকিৎসকের সময়ের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়।

রোগ সংক্রমণের সুযোগ হ্রাসঃ

কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসকের চেম্বারের অপেক্ষমাণ রোগীর কাছে থেকে অন্যদের রোগ সংক্রমণের আশংকা থেকে যায় কিন্তু টেলিমেডিসিনের ক্ষেত্রে এরকমটি হওয়ার সুযোগ নেই।

বৃদ্ধ ও শিশুদের বিশেষ সুবিধাঃ

দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত বৃদ্ধ বা শিশুকে হর-হামেশাই চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া অনেক ক্ষেত্রেই বেশ কষ্টকর এবং অসুবিধাজনক। টেলিমেডিসিন এক্ষেত্রে অনেকটাই সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।

টেলিমেডিসিনের চ্যালেঞ্জ

সাইবার সিকিউরিটিঃ

টেলিমেডিসিনে যেহেতু ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে ডাটা আদান-প্রদান হয় তাই হ্যাকাররা প্রয়োজনীয় তথ্যের জন্য হ্যাকিংয়ের আশ্রয় নিতে পারে।

কারিগরি দক্ষতাঃ

টেলিমেডিসিন সেবা পাওয়ার জন্য ন্যূনতম কারিগরি দক্ষতা থাকা আবশ্যক তবে অনেকের ক্ষেত্রে এটি অনুপস্থিত যা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারে।

ইন্টারনেট সুবিধাঃ

টেলিমেডিসিন সেবা পাওয়ার জন্য ইন্টারনেট সুবিধা অন্যতম নিয়ামক কিন্তু শতভাগ এলাকা বা মানুষ ইন্টারনেট সেবার আওতাভুক্ত এমনটি বলা যায় না অর্থাৎ তাদের জন্য এ সেবা পাওয়া কষ্টকর।

প্রেসক্রিপশন করার অসুবিধাঃ

ইদানীং বেশ কিছু সফটওয়্যারের মাধম্যে দূরবর্তী স্থানে প্রেসক্রিপশন প্রদান সম্ভব হলেও গ্রহীতার বিশেষ সুবিধা থাকতে হয় যা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না।

আইনি জটিলতাঃ

এখন পর্যন্ত অনেক দেশেই টেলিমেডিসিনের জন্য সাদৃশ্যপূর্ণ আইন বা নিয়ম তৈরি হয়নি যে কারণে সেবা দাতা ও গ্রহীতার অধিকার সীমা নির্ধারণ করা কঠিন। এমনকি বড় আয়তনের দেশে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে আইনের ভিন্নতা থাকলে তা আরও বেশি সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায় কারণ টেলিমেডিসিনের ক্ষেত্রে ভৌগোলিক অবস্থান বড় নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায় না।

জরুরি সেবার সুযোগ না থাকাঃ

জরুরি সেবার ক্ষেত্রে টেলিমেডিসিন অনেকটাই অনুপযোগী যেমন- হার্টঅ্যাটাক, স্ট্রোক, হাড়ভাঙা, কেটে যাওয়া বা এমন কোনো সেবা যেখানে সেবাদাতার সরাসরি হাতের কাজ আছে কারণ এসব ক্ষেত্রে রোগী ও চিকিৎসকের সরাসরি সাক্ষাতের বিকল্প নেই।

অতিসম্প্রতি প্রকাশিত একটি স্টাডির ফলাফলে প্রকাশিত হয়েছে যে, যারা টেলিমেডিসিন সেবা গ্রহণ করেন তারা অপেক্ষাকৃত কম মাত্রায় উদ্বিগ্নতা, মানসিকচাপ ও দুশ্চিন্তা অনুভব করেন এবং তাদের ক্ষেত্রে অসুস্থতাজনিত হাসপাতালে ভর্তি হার শতকরা ৩৮ ভাগ কম।

বর্তমান সময়ে টেলিমেডিসিন একটি ১৭.৮ বিলিয়ন ডলারের শিল্প যার বার্ষিক প্রবৃদ্ধি শতকরা ১৮.৪ ভাগ। অর্থাৎ এ শিল্প দ্রুত বর্ধনশীল এবং এ থেকে আলাদা থাকার সুযোগ কম।

হাসপাতালের বহির্বিভাগের ওপর চাপ কমান, সেবাদাতা ও গ্রহীতার সুবিধা, সবার কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছান, চিকিৎসা খরচ কমান প্রভৃতি বিষয় বিবেচনায় টেলিমেডিসিনে আমাদের আরও বেশি মনোযোগী হওয়া দরকার।

লেখক : ফার্মাসিস্ট

টেলিমেডিসিন এর বিষয় আরো বিস্তারিত জানতে চোখ রাখুন

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদিত (স্মারক নং-স্বাঃ অধিঃ/এমআইএস/২০১৮/৯১০ তারিখ: ১৮/০৭/২০১৮) একমাত্র প্রাইভেট টেলিমেডিসিন কোম্পানী।

Human Health HelplineH H H

সূত্র: যুগান্তর

2 thoughts on “টেলিমেডিসিন স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন

  1. MD.ANOARUL ISLAM says:

    আসসালামু আলাইকুম
    টেলিমেডিসিন ও ট্রিপল এইচ সাস্থ্য সেবায় এক নতুন সম্ভাবনা উম্মুক্ত করেছে ওয়াল্ড ফেমাস ই-কমার্স মাকেটিং লিঃ এর পরিবারের জন্যে। সর্বোচ্চ কাযক্রম চালিয়ে এই সেবা ঘরে ঘরে পৌছিয়ে দিতে হবে। এই দায়িত্ব সবাইকে পালন করতে হবে।

Leave a Reply