মা-বাবার খেদমতের গুরুত্ব ( ২য় পর্ব )

হযরত ওয়াইস করনী রহ. এর মায়ের সেবাঃ


হযরত ওয়াইস করনী রহ. নবীজির জামানায় জীবিত ছিলেন এবং মুসলমান ছিলেন। তার একান্ত বাসনা ছিল, নবীজির দরবারে গিয়ে সরাসরি তার সঙ্গে মোলাকাত করবেন, যার মোলাকাত ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে বড় নেয়ামত। তিনি যখন দুনিয়া থেকে বিদায় নিবেন তখন এমন সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে। হযরত ওয়াইস করনী নবীজিকে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার একান্ত চাওয়াপাওয়া আপনার দরবারে হাজির হওয়া। কিন্তু আমার আম্মা অসুস্থ তার খেদমত প্রয়োজন। রাসুলুল্লাহ  তাকে নিষেধ করে দিলেন এবং বললেন, তুমি আমার সাক্ষাতের জন্য এসো না বরং বাড়িতে থাকো এবং মায়ের খেদমত করো।
যার ঈমান ছিল ইস্পাতের মত মজবুত, যার অন্তরে তড়ফ ছিল। রাসূলুল্লাহ এর প্রতি ভালোবাসায় যার হৃদয় বিগলিত ছিল। রাসুলুল্লাহ কে একনজর দেখার জন্য যিনি ছিলেন মাতোয়ারা। সুতরাং তার হৃদয়ের অবস্থা কতটা পাগলপারা তা কি কল্পনা করা যায়! আজকের উম্মতের হৃদয়ের ব্যাকুলতার প্রতিই দেখুন না! নবীজির একজন উম্মত! কিভাবে কামনা করে রওজা শরীফের জিয়ারত! অথচ ওয়াইস করনী তখন জীবিত ছিলেন। তাহলে তার মনের অবস্থা না জানি কেমন ছিল! কিন্তু তিনি নিজের মনের বাসনাকে মনেই পুষে রাখলেন। রসুলুল্লাহ এর হুকুমের সামনে নিজের কামনাকে কোরবান করে দিলেন। মায়ের খেদমতের জন্য এই মহান সৌভাগ্য ছেড়ে দিলেন। ফলে তিনি সাহাবী উপাধিতে ভূষিত হতে পারলেন না। অথচ একজন সাধারণ সাহাবীর মর্যাদাও এত বেশি যে, একজন অলি যত বড় অলি হোন না কেন, কিন্তু তিনি একজন সাধারণ সাহাবির মর্যাদার কাছেও যেতে পারেন না।

মায়ের খেদমতে নিয়োজিত থাকোঃ


যাহোক রাসুলুল্লাহ উয়াইস কারনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, আমার সঙ্গে সাক্ষাতের প্রয়োজন নেই। সাহাবী হওয়ার মর্যাদা লাভের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন তোমার মায়ের খেদমতে থাকা। তাই তুমি মায়ের খেদমতে থাকো।আমাদের মতো নির্বোধ কেউ হলে তো বলে বসত, সাহাবী হওয়ার সৌভাগ্য তো আর পরে পাওয়া যাবে না। মা অসুস্থ তো কী হয়েছে! এমনিতে বিভিন্ন প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে যেতে হয়। নবীজির সাক্ষাৎ তো একটি বিরাট প্রয়োজন। সুতরাং আমি যাব এবং সাক্ষাৎ করে আবার চলে আসব। কিন্তু ওয়াইস কারনী এমনটি করেন নি।
কারণ নিজের আবেগ কিংবা বাসনা পূরণ করা তার নিকট মুখ্য বিষয় ছিল না। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহ তাঁর রসূলের হুকুম পালন করা।তাই তিনি নিজের আবেগকে কোরবান করলেন এবং নিজেকে মায়ের খেদমতে নিয়োজিত রাখলেন। ইতোমধ্যে রাসুলুল্লাহ ইন্তেকাল করলেন। ওয়াইস করনীর নবীজির মোলাকাত আর ভাগ্যে জুটলো না।

মায়ের খেদমতের পুরস্কারঃ


কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাকে মায়ের খেদমতের পুরস্কার দিলেন। রাসূলুল্লাহ হযরত ওমরকে বলে গিয়েছেন, করন নামক স্থান থেকে এক ব্যক্তি মদিনায় আসবে। তার আকৃতি গঠন এরকম হবে। যদি তুমি তার দেখা পাও তাহলে তার দ্বারা তোমার জন্য দোয়া করাবে। আল্লাহ তাআলা তার দোয়া কবুল করবেন।
ইতিহাসে রয়েছে, হযরত ওমর প্রতিদিন ওই মহান ব্যক্তির অপেক্ষায় থাকতেন। ইয়ামানের কোনো কাফেলা মদিনাতে প্রবেশ করামাত্র তিনি সেখানে ছুটে যেতেন এবং জিজ্ঞেস করতেন, কাফেলায় ওয়াইস করনী আছে কি? একবার সত্যি সত্যি এক কাফেলার সঙ্গে তিনি আসলেন। ওমর খুশিতে আন্দোলিত হলেন। তার কাছে নিজেই হাজির হলেন। নাম জিজ্ঞেস করলেন। নবীজি  যে গঠনাকৃতি বলেছিলেন তার সাথে হুবহু মিল খুঁজে পেলেন। তারপর তিনি দরখাস্ত করলেন, আমার জন্য দোয়া করুন। ওয়াইস করনী বললেন, আমার দোয়ার জন্য আপনি কেন এত ব্যাকুল হলেন? ওমর উত্তর দিলেন, এটা আমার নবীজি এর নির্দেশ। তিনি বলেছেন, আল্লাহ আপনার দোয়া কবুল করবেন। ওমর এর কাছে তথ্য শুনে ওয়াইস করনী চোখের পানি ছেড়ে দিলেন। তিনি এই বলে অঝোরধারায় কেঁদে চললেন যে, আল্লাহর রাসূল আমাকে এই গৌরব দান করলেন!

মাতাপিতার খেদমতের ফজিলতঃ


প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ  বলেছেন, মাতাপিতার খেদমত সকল ইবাদতের উপর প্রাধান্য পাবে। কোরআন মজিদেও এই প্রসঙ্গে একাধিক আয়াত রয়েছে,

وَوَصَّيْنَا الْإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ إِحْسَانًا

আমি মানবসম্প্রদায়কে উপদেশ দিয়েছি যে, তারা যেন নিজেদের মাতাপিতার সঙ্গে সদাচরণ করে।
অন্য আয়াতে এসেছে,

وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا

আপনার প্রভূ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত আর কারো ইবাদত করবে না এবং মাতাপিতার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে।

এখানে মাতাপিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করার বিষয়টি তাওহীদের সাথে আলোচিত হয়েছে। তাওহীদের পর সর্বপ্রথম দায়িত্ব কর্তব্য কী হবে; তা বলে দেয়া হয়েছে। আর তাহল, মাতাপিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা।

মাতাপিতা যখন বৃদ্ধ হবেঃ


তারপর মহান আল্লাহ উপদেশের ভঙ্গিতে বলেন,

إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِندَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلاَهُمَا فَلاَ تَقُل لَّهُمَآ أُفٍّ

তোমাদের জীবদ্দশায় মাতাপিতা যখন বার্ধক্যে উপনীত হবে তখন তাদের ক্ষেত্রেউফশব্দটিও উচ্চারণ করো না।
বার্ধক্যের আলোচনা সবিশেষ করা হয়েছে। কারণ বার্ধক্যের প্রভাবে অনেক ক্ষেত্রে মানুষ স্বাভাবিক থাকে না। তখন অহেতুক কিংবা ভুল কথা নিয়েও মানুষ বাড়াবাড়ি করতে থাকে। তাই আল্লাহ তাআলা বিশেষভাবে বার্ধক্যের কথা তুলে ধরেছেন যে, তোমার মাতাপিতা বয়সে উপনীত হলে হয়তো ভুল অথবা অন্যায় আচরণও দেখাতে পারেএটা অসম্ভব কোন কিছু নয়। তবে তোমার কর্তব্য হলো, তাঁদের সাথে কোমল আচরণ করবে। কখনো বিরক্তি কিংবা অনীহা প্রকাশ করবে না। এরপর আল্লাহ তাআলা আরো বলেছেন,

وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُل رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِى صَغِيراً

তাদের সামনে বিনয়ের ডানা বিছিয়ে দিবে, দোয়া করতে থাকবে, হে আল্লাহ! তাদের উপর রহম করুন, যেভাবে তারা শিশুকালে আমাকে দয়া করে প্রতিপালন করেছেন।
বৃদ্ধকালে মেজাজে রুক্ষতা চলে আসে তাই বিশেষভাবে বৃদ্ধকালের অবস্থার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। অন্যথায় মাতাপিতা সর্বাবস্থায়ই ভক্তিশ্রদ্ধা সম্মানের পাত্র। তাঁদের কার্যকলাপে কখনো অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা উচিত নয়।

মাতা পিতার সঙ্গে সদাচরণঃ


আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন। মনে রেখো, বুড়ো হয়ে গেলে মাতাপিতার মাঝে খিটখিটে মেজাজ চলে আসে। এটা স্বাভাবিক। তাঁদের অনেক কথা তখন মনে হবে বিরক্তিকর অহেতুক। তখন মনে রাখতে হবে, এর চেয়েও বিরক্তিকর অহেতুক কথা তোমার ছোট বেলায় তাঁরা সহ্য করেছিলেন। সুতরাং তোমরাও তাঁদের অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা সহ্য করতে হবে। এমনকি যদি তাঁরা কাফেরও হয় তবুও। পবিত্র কোরআনের বক্তব্য শুনুন,

وَإِن جَاهَدَاكَ عَلَىٰ أَن تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا ۖ وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا

তোমাদের মাতাপিতার যদি কাফেরমুশরিক হন তাহলে এই গর্হিত কাজে তোমরা তাদের অনুসরণ করবে না। কিন্তু সাধারণ জীবনযাপনে তখনও তোমরা তাদের কথাবার্তা মেনে চলতে হবে। কারণ তারা কাফের হলেও তাঁরা তোমার আব্বা, তোমার আম্মা।
মাতাপিতার আনুগত্য এবং তাঁদের সঙ্গে উত্তম আচরণের জন্য অত্যন্ত জোরালোভাবে বলা হয়েছে। অথচ বর্তমান দুনিয়ার স্রোত চলছে উল্টোদিকে। চলছে নিয়মতান্ত্রিক প্রশিক্ষণ। মাতাপিতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সন্তানের হৃদয় থেকে মুছে ফেলার প্রশিক্ষণ। বলা হচ্ছে, মাতাপিতা মানুষ। আমরাও মানুষ। আমাদের মাঝে এবং তাঁদের মাঝে কোনো ব্যবধান নেই। আমাদের উপর তাদের আবার কিসের অধিকার! মানুষ যখন দীন থেকে দূরে সরে যায়, আল্লাহ তাঁর রাসূলের আনুগত্য যখন মূল্যহীন দেখা দেয়, যখন আখেরাতের ভাবনা মানুষ থেকে উঠে যায় তখনই বের হতে পারে জাতীয় জঘন্য কথা! আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করুন আমীন।

মাতাপিতার নাফরমানীঃ


মাতাপিতার আনুগত্য ওয়াজিব। তাঁদের আদেশনিষেধ সন্তানের জন্য অপরিহার্য। এটা শরীয়তের বিধান। নামাজরোজার মতই একটি অপরিহার্য বিধান। তবে এখানে একটা শর্ত আছে তা হলো, মাতাপিতার নির্দেশ হতে হবে ইসলামের গণ্ডির ভেতরে। ইসলামের গন্ডি থেকে যদি মাতাপিতা কোন নির্দেশ দেন তাহলে তা পালন করা ওয়াজিব। পালন না করলে ঠিক এমন গুনাহ হবে যেমন হয় নামাজ ছেড়ে দিলে। একেই বলা হয় মাতাপিতার নাফরমানী। বুযুর্গানে দ্বীন বলেন, মাতাপিতার নাফরমানীর শাস্তি হলো, মৃত্যুকালে কালিমা নসীব হবে না। 

আল্লাহ আমাদেরকে  মা- বাবার সেবা করার তৈফিক দান করুন আমীন।

মা-বাবার খেদমতের গুরুত্ব ( ৩য় পর্ব ) পড়ার জন্য চোখ রাখুন।

Leave a Reply