মা-বাবার খেদমতের গুরুত্ব ( ১ম পর্ব )

আর ইবাদত কর আল্লাহর, শরীক করো না তাঁর সাথে অপর কাউকে। পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর এবং নিকটাত্মীয়, এতিম, মিসকিন, প্রতিবেশী, অসহায় মুসাফির এবং নিজের দাস-দাসীর প্রতিও।’ (সূরা নিসা ৩৬)

বান্দার হকের আলোচনাঃ

‌আল্লামা নববী রহ. এখানে একটি নতুন পরিচ্ছেদের সূচনা করেছেন। বাবা-মায়ের সঙ্গে সদাচরণ এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা প্রসঙ্গে এই পরিচ্ছেদে আলোকপাত করেছেন। যেমন আমি আগেও বলেছি, চলতি পরিচ্ছেদগুলোর বিষয়বস্তু হল, বান্দার হক। কিছু আলোচনা পূর্বে করা হয়েছে। এই নতুন পরিচ্ছেদের আলোচ্য বিষয় মাতাপিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার এবং আত্মীয়স্বজনের হক। এ সুবাদে তিনি কোরআনের আয়াতের পর সর্বপ্রথম যে হাদীসটি এনেছেন, তা হল,

عَنْ عَبْدِ اللّه بن مَسْعُودٍ رضي اللّه عنه قال: سَأَلْتُ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ : أَيُّ الْأَعْمَالِ أَحَبُّ إِلَى اللَّهِ ؟ قَالَ : الصَّلَاةُ عَلَى وَقْتِهَا قُلْتُ : ثُمَّ أَيٌّ ؟ قَالَ : ثُمَّ بِرُّ الْوَالِدَيْنِ قُلْتُ : ثُمَّ أَيٌّ ؟ قَالَ : ثُمَّ الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ

হযরত আবু আব্দুর রহমান আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ ﷺ–কে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহ তাআলার নিকট সবচেয়ে প্রিয় আমল কোনটি? তিনি বললেন, যথাসময়ে নামাজ আদায় করা । তারপর আমি জিজ্ঞেস করলাম, নামাজের পর কোন আমলটি তার কাছে সবচেয়ে প্রিয়? উত্তর দিলেন, মাতা পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করা । আমি পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম, তারপর কোনটি? প্রতিউত্তরে নবীজী  বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। (বুখারী শরীফ)
‌হাদীসটিতে দীনের কাজ বিন্যাস করা হয়েছে যথাক্রমে– এক. নামাজ আদায় করা। দুই. মাতা-পিতার সাথে উত্তম ব্যবহার করা। তিন. আল্লাহর রাহে জিহাদ করা।

মাতা-পিতার খেদমতকে জিহাদের সাথে তুলনা করা হইছেঃ

আলোচ্য হাদীসের ক্রমধারামতে দ্বিতীয় স্তরের উত্তম কাজ হলো, বাবা-মায়ের খেদমত করা। তৃতীয়তে উল্লেখ করা হয়েছে, আল্লাহর রাহে জেহাদ করা। মাতাপিতার সেবার সূচিবিন্যাস জিহাদের মতো মহান আমলেরও উপরে। অথচ জিহাদ এত বড় আমল যে, হাদীস শরীফে এসেছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে জিহাদ করে শহীদ হয়ে যায় আল্লাহ তাকে সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুর মত পবিত্র করে তোলেন। অপর হাদীসে এসেছে, মুমিন বান্দা মৃত্যুর পর আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্য লাভে ধন্য হবে, আল্লাহর দিদার লাভে দীপ্ত হবে, জান্নাতে তার দর্শন পাবে। তখন তার অন্তরে দুনিয়ায় পুনরায় আসার কোনো আকাঙ্ক্ষা জাগবে না। কারণ তখন তার সামনে দুনিয়ার স্বরূপ উন্মোচিত হয়ে যাবে, জান্নাতের তুলনায় দুনিয়ার তুচ্ছতা প্রতিভাত হবে। দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী, দুনিয়ার সুখশান্তি স্বল্পমেয়াদী; জান্নাত চিরস্থায়ী, জান্নাতের সুখ শান্তি দীর্ঘমেয়াদী–এসব বিষয়ে তার সামনে স্পষ্ট হয়ে যাবে। তাই সে দুনিয়াতে ফিরে আসার কামনা করবে না। কিন্তু যে ব্যক্তি জিহাদ করেছে এবং শহীদ হয়েছে সে তামান্না জানাবে, আহা! দুনিয়াতে যদি আবার যাওয়া যেত তাহলে ফের আল্লাহর রাহে জিহাদ করতাম । পুনরায় শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করতাম। এজন্য রসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, আমার হৃদয়ের তামান্না হল, আমি আল্লাহর পথে জিহাদ করে জীবন বিলিয়ে দেই। তারপর পুনরায় জীবিত হয়ে শহীদ হয়ে যাই আবার জীবিত হই এবং শহীদ হয়ে যাই।
মোটকথা, জান্নাতের ঠিকানায় পৌঁছে মানুষ দুনিয়ায় ফিরে আসার কামনা করবে না। কিন্তু শুধুই শহীদগণ ফিরে আসার বাসনা করবে। এই হলো, জিহাদের মর্যাদা।

মাতা পিতার হকঃ

পার্থিব জগতে রয়েছে হাজারো ভালোবাসা। রয়েছে বহু ধরনের সম্পর্ক। এসব সম্পর্ক ও ভালোবাসার মাঝে লুকিয়ে থাকে কোনো না কোনো স্বার্থ। কোনো না কোনো আশা। ভালবাসার বিচিত্র এই ভুবনে নির্ভেজাল শুধু একটাই তাহলো, সন্তানের প্রতি মাতা-পিতার মায়া-মমতা। এটা তাদের স্বভাবজাত। এর মাঝে থাকে না কোনো স্বার্থ । থাকে না কোনো উদ্দেশ্য। এছাড়া অন্য কোনো মহব্বত বেগরজ নয়। নিঃস্বার্থ নয়। যেমন স্বামীস্ত্রীর ভালবাসা এর মধ্যে লুকিয়ে থাকে অনেক আশা-ভরসা। ভাইয়ের সঙ্গে মহব্বত। তাতেও থাকে আদান-প্রদান।
মোটকথা, দুনিয়ার সমূহ সম্পর্ক উদ্দেশ্যমুক্ত দাবি করা যাবে না। কেবল একটি মহব্বত একটি স্নেহ ও মায়া সকল স্বার্থ থেকে মুক্ত। তাহলো মাতা-পিতার মায়া ও করুণা। মাতা-পিতার মহব্বত একেবারে নির্ভেজাল। সম্পূর্ণ নিখাঁদ। এমনকি সন্তানের জন্য তাদের আবেগ এত বেশি থাকে যে, প্রয়োজনে নিজেকে বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত থাকে। এজন্য আল্লাহ তাআলা তাদের হকসমুহের মূল্যায়ন করেছেন। এমনকি তাঁর পথে জিহাদ করার চেয়েও মাতা-পিতার হককে অধিক প্রাধান্য দিয়েছেন।

মাতা-পিতার সেবাঃ

‌হাদীস শরীফে এসেছে, এক সাহাবী নবীজী -এর দরবারে এসে আরজ করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার আন্তরিক ইচ্ছা হলো, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবো। উদ্দেশ্য, শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং সওয়াব প্রাপ্তি। শুধু এই উদ্দেশ্যে আমি জিহাদে যেতে চাই। রাসূল  বললেন, তুমি কি সত্যিই সাওয়াবের নিয়তে জিহাদে যেতে চাও? উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, আল্লাহ রাসুল! এটাই আমার উদ্দেশ্য। রাসূলুল্লাহ  জিজ্ঞেস করলেন, তোমার পিতা-মাতা কি বেঁচে আছেন? সাহাবী উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, তারা জীবিত আছেন। রাসূলুল্লাহ  বললেন, যাও বাড়িতে ফিরে যাও। পিতা-মাতার খেদমত করো। তুমি মাতা-পিতার খেদমতে যে সব পাবে জিহাদ করে সেসব পাবে না।
‌ এক বর্ণনায় এসেছে,

فَفِيهِمَا فَجَاهِدْ

যাও, তাদের খেদমতে আত্মনিয়োগ করার মাধ্যমে জিহাদ করো।

এ হাদিসে মাতা-পিতার খেদমত কে জিহাদের চেয়েও অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। (বুখারী শরীফ)

আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে আমল করার তৌফিক দান করুন। আমীন।

মা-বাবার খেদমতের গুরুত্ব ( ২য় পর্ব ) পড়ার জন্য চোখ রাখুন।

Leave a Reply