শিশুর মানসিক বিকাশে ইলেকট্রনিক ডিভাইসের প্রভাব।

ডা. গোপেন কুমার কুণ্ডু, চেয়ারম্যান, শিশু নিউরোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রযুক্তির বিস্ময়কর সৃষ্টি হলো মোবাইল ফোন। বর্তমান বিশ্বে যোগাযোগের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো মোবাইল ফোন ডিভাইস। যোগাযোগের মাধ্যম ছাড়াও এটি শিক্ষা ও গবেষণার কাজে ব্যবহৃত হয়। আজকাল একক পরিবারের বেশির ভাগ মা তাদের শিশুদের হাতে এই যন্ত্র দিয়ে নিজেদের কাজকর্ম সম্পাদন করে থাকেন।

বিজ্ঞাপনঃ

কিন্তু অতিমাত্রায় এই ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহারের ফলে শিশুর সামাজিক যোগাযোগ ও শারীরিক কসরত কমে যাওয়া, আচরণগত অসুবিধা, অসামাজিকতা, অতিচঞ্চলতা, হিংসাত্মক আচরণ, স্বাভাবিক স্নায়বিক বিকাশ কমে যাওয়া, চক্ষু সমস্যা, মাথা ব্যথা ইত্যাদি হতে পারে। তখন তাদের সামাজিক দক্ষতা ও মনস্তাত্ত্বিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। এতে শিশুদের মুখোমুখি যোগাযোগ ও হাতের কাজের প্রতিও অনীহা তাৈর হয়। এ ছাড়া যেসব সমস্যা হয় তা হলো—

স্ক্রিন ডিপেনডেন্সি ডিসঅর্ডারঃ

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, মায়েরা তাদের শিশুকে খাওয়ানোর সময় এই ডিভাইস ব্যবহার করেন। এতে একসময় তাদের মধ্যে এমন অভ্যাসে পরিণত হয়, যেন এই যন্ত্র ছাড়া শিশুকে খাওয়ানো সম্ভবই না। এ ছাড়া অনেক দিন ধরে মোবাইল ব্যবহার করলে তাদের কারো কারো মধ্যে স্ক্রিন ডিপেনডেন্সি ডিসঅর্ডারস (এসডিডি) হতে পারে।

এতে কিছু শারীরিক সমস্যা যেমন ঘুমের অসুবিধা, পিঠ বা কোমরে ব্যথা, মাথা ব্যথা, চোখের জ্যোতি কমে যাওয়া, ওজন বেড়ে যাওয়া, পুষ্টিহীনতা ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া কারোর মানসিক উপসর্গ যেমন—উদ্বিগ্নতা, দোষীবোধ, অসততা, একাকিত্বতা ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।

শিশুর মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়ঃ

মোবাইল ফোন সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে দুই-পাঁচ বছরের শিশুরা। একটি শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশের উপযুক্ত সময় প্রথম পাঁচ বছর। মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ হলো—আস্তে আস্তে এক থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে শিশুর কথা বলতে শেখা, হাঁটাচলা শেখা এবং স্বাভাবিক বুদ্ধির বিকাশ হওয়া। আর এ সময় শিশুর একদিকে দীর্ঘ সময় মোবাইল গেম খেলা, ইউটিউব দেখা, অন্যদিকে স্বাভাবিক উদ্দীপনামূলক খেলাধুলা না করায় তার স্নায়বিক বিকাশ ভীষণভাবে ব্যাহত হয়। মস্তিষ্কের বিকাশ নির্ভর করে পরিবেশ ও অন্য শিশুদের সঙ্গে শিশুর ভাবের আদান-প্রদানের ওপর। বলা হয়, শিশু শেখে দেখতে দেখতে এবং অন্যদের সঙ্গে খেলতে খেলতে।

অধিক সময় শিশু ইলেকট্রনিক ডিভাইসের সংস্পর্শে থাকায় মা-বাবার সঙ্গে শিশুর সামাজিক যোগাযোগ এবং সমবয়সী শিশুর সঙ্গে খেলাধুলা ও মেলামেশা একেবারেই কমে যায়। এ ক্ষেত্রে গবেষকরা শিশুর বিকাশের প্রারম্ভে, অত্যধিক মোবাইল ব্যবহার শিশুর মস্তিষ্কের গঠন প্রকৃতির ভিন্নতার কথাও উল্লেখ করেছেন।

অতিমাত্রায় মোবাইল ফোন এবং টিভি দেখা শিশুদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে অতিমাত্রায় চঞ্চলতা দেখা দিতে পারে। বিজ্ঞানী ডি এ থমসন বলেছেন, অতিমাত্রায় মোবাইল, টেলিভিশনে আসক্তি এবং ঘুমের সময় কমে যাওয়া শিশুদের বিকাশের বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

উইথড্রল সিম্পটমসঃ

অধ্যাপক ডা. এরিখ সিগম্যান তাঁর গবেষণায় বলেছেন, অনেক সময় হঠাৎ করে শিশুদের কাছ থেকে এই মোবাইল ডিভাইস তুলে নিলে তাদের মধ্যে উইথড্রল সিম্পটমস আসতে পারে। তখন তারা মোবাইল থেকে সহজেই বিরত থাকতে পারে না অথবা মোবাইল সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে পারে না। তাদের ঘরের বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা বা প্রবণতা কমে যায়। দীর্ঘ সময় ধরে মোবাইল ফোন ব্যবহারের ফলে নানা উপসর্গ প্রকাশ পায়।

মা-বাবার করণীয়ঃ

আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিকস ও টেলিভিশন কমিটি শিশুদের ইলেকট্রনিক মিডিয়া ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্বসম্মতিক্রমে নিম্নরূপ পরামর্শ দিয়েছে।

♦ ২-৫ বয়সের শিশুরা সারা দিনে ১-২ ঘণ্টা স্ক্রিন দেখতে পারবে, কিন্তু সেটি একটি কোয়ালিটি প্রগ্রাম হতে হবে।

♦ দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে মোবাইল ডিভাইস দেওয়া যাবে না।

♦ শিশুদের ঘুমানোর রুমে টেলিভিশন থাকলে তা সরিয়ে ফেলতে হবে।

♦ শিশু বিকাশের ক্ষেত্রে কিছু উদ্দীপনা যেমন শিশুর সঙ্গে কথা বলা, গল্প করা, ছড়া বলা, গান করা ইত্যাদি করতে হবে।

Leave a Reply