মা-বাবার খেদমতের গুরুত্ব ( ৪র্থ পর্ব )

মাতাপিতার মৃত্যুর পর ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাঃ

অনেকের ক্ষেত্রে এমন হয় যে, মাতা-পিতার ইন্তিকালের পর অনুভূতি জাগে, হায়! কত বড় নিয়ামত আমরা হারিয়ে ফেললাম! আমরা তাঁর কদর করতে পারলাম না। এমন অনুভূতিসম্পন্ন লোকের জন্য আল্লাহ তাআলা একটা ব্যবস্থা রেখেছেন। ইরশাদ হয়েছে, কেউ যদি মাতা-পিতার হক আদায় না করে থাকে, তাঁদের থেকে লাভবান হওয়ার সুযোগ হারিয়ে ফেলে তবে এর ক্ষতিপূরণের দু’টি পথ আছে।

এক তাদের জন্য বেশি বেশি ইসালে সওয়াব করবে। দান-খয়রাত করে নফল নামাজ পড়ে সাধ্য অনুযায়ী তাদের জন্য সওয়াব পাঠাতে থাকবে। এর মাধ্যমে পূর্বের ক্ষতি পূরণ হবে।

দুই মাতা-পিতার আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব ও আপনজনের সাথে সদাচরণ করবে। মা-বাবার সাথে যেমন ব্যবহার করা উচিত ছিল তাদের সাথে তেমন ব্যবহার করবে। এর ফলে আল্লাহ তাআলা পূর্ব ত্রুটির ক্ষতিপূরণ দেবেন। আল্লাহ আমাদেরকে আমল করার তৌফিক দান করুন। আমীন।

মায়ের তিন হক এবং পিতার এক হকঃ

عن أبي هريره رضي الله عنه جَاءَ رَجُلٌ إلى رَسُولِ اللهِ، فَقالَ: مَن أَحَقُّ النَّاسِ بحُسْنِ صَحَابَتِي؟ قالَ: أُمُّكَ قالَ: ثُمَّ مَنْ؟ قالَ: ثُمَّ أُمُّكَ قالَ: ثُمَّ مَنْ؟ قالَ: ثُمَّ أُمُّكَ قالَ: ثُمَّ مَنْ؟ قالَ: ثُمَّ أَبُوكَ

সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, এক ব্যক্তি নবীজি -এর দরবারে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সারা বিশ্বের মানুষের মাঝে আমার সদাচরণ পাওয়ার সবচেয়ে বেশি হকদার কে? নবীজি  উত্তর দিলেন, তোমার মা অর্থাৎ সবচেয়ে বেশি হকদার তোমার মা। লোকটি পুনরায় প্রশ্ন করল, তারপর কে? নবীজি  উত্তর দিলেন, তোমার মা। লোকটি আবারও প্রশ্ন করল, তারপর কে? নবীজি  এবারও উত্তর দিলেন, তোমার মা। সাহাবী চতুর্থবার একই প্রশ্ন করল যে, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তারপর কে? এবার নবীজী  বললেন, তোমার পিতা।

রাসূলুল্লাহ  তিনবার মায়ের কথা বলেছেন। চতুর্থবারে বাবার কথা বলেছেন। তাই এই হাদিসের আলোকে ওলামায়েকেরাম বলেছেন, বাবার চেয়ে মায়ের হক বেশি। কারণ সন্তান লালন-পালনে মায়ের ভূমিকা এবং কষ্ট পিতার চেয়েও বেশি। পিতা মায়েরর চারভাগের একভাগ কষ্টও করেন না বিধায় মায়ের নাম নেওয়া হয়েছে তিন বার। আর পিতার নাম নেওয়া হয়েছে একবার।

পিতার আজমত, মায়ের খেদমতঃ

এজন্য বুযুর্গানে দ্বীন বলেছে্‌ পিতার তুলনায় মা হাদিয়া পাওয়ার অধিক উপযোগী। বুযুর্গানে দ্বীন আরো বলেছেন, এখানে মূলত দুইটি বিষয়। একটি হলো, আজমত তথা মর্যাদা প্রদর্শন। আর দ্বীতিয়টি হল, খেদমত ও সদাচারণ। প্রথম বিষয়টিকে প্রাধান্য পাবে বাবা। আর দ্বিতীয় বিষয়টির ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবে মা। আজমতের অর্থ হলো, পিতার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা অন্তরে রাখা। যেমন তার দিকে পা ছড়িয়ে বসে না থাকা। তার মাথার নিকট বসবে। এভাবে আদবের জন্য আরও যা করতে হয় সবগুলো করবে। এক্ষেত্রে পিতার হক প্রাধান্য পাবে। আর খেদমতের ব্যাপারে মায়ের হক প্রাধান্য পাবে। এমনকি পিতার চেয়েও তিনগুণ বেশি। এটা আল্লাহর অশেষ কুদরত যে, সন্তান আর মায়ের মাঝে এক বিশেষ গুণ রেখেছেন। যে গুণের কারণে সন্তান মায়ের সাথে যতটুকু ফ্রি থাকে, বাবার সাথে ততটুকু ফ্রি থাকে না। মায়ের সাথে সন্তানের আন্তরিকতা বেশি বিধায় এমন অনেক কথা আছে যা পিতার সামনে বলা যায় না। অথচ তা মায়ের সামনে নির্দ্বিধায় বলা যায়
হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি রহ. ফাতহুল বারিতে বুযুর্গানে দীনের মূলনীতি আলোচনা করেছেন যে, পিতার আজমত হবে বেশি। আর মায়ের খেদমত হবে বেশি। উক্ত মূলনীতির মাধ্যমে হাদীস শরীফের সঠিক ব্যাখ্যা ফুটে উঠে।

মায়ের খেদমতের ফলঃ

মায়ের খেদমত অনেক সৌভাগ্যের বিষয়। যার মাধ্যমে মানুষ উঁচু থেকে আরো উঁচু হয়। যেমন হযরত ওয়াইস করনী রহ.-এর ঘটনায় বিষয়টি দীপ্তিময় হয়ে উঠেছে। আরো অনেক বুজুর্গ সম্পর্কেও এজাতীয় ঘটনা আছে। যেমন ইমাম গাজ্জালী রহ. সম্পর্কে প্রসিদ্ধ আছে যে, তিনি দীর্ঘদিন কেবল মায়ের খেদমতের কারণে ইলম অর্জন করতে পারেন নি। কিন্তু যখন মায়ের খেদমত থেকে অবসর হলেন আল্লাহ তাআলা তাকে ইলমি জগতের উজ্জ্বল পুরুষ বানিয়ে দিলেন। তাই মাতা-পিতার খেদমত অবশ্যই এক মহান সম্পদ।

ফিরে যাও, তাঁদের খেদমত করোঃ

عن عبداللَّه بن عمرو بن العاص رضي اللَّه عنهما قَالَ: أَقْبلَ رجُلٌ إِلى نَبِيِّ اللَّه  فَقَالَ: أُبايِعُكَ عَلَى الهِجرةِ وَالجِهَادِ أَبْتَغِي الأَجرَ مِنَ اللَّه تعالى، قال: فهَلْ لكَ مِنْ والِدَيْكَ أَحدٌ حَيٌّ؟ قَالَ: نعمْ، بَلْ كِلاهُما، قَالَ: فَتَبْتَغِي الأَجْرَ مِنَ اللَّه تَعَالَى؟ قَالَ: نعمْ، قَالَ: فَارْجِعْ إِلى والِدَيْكَ فَأَحْسِنْ صُحْبَتَهُما

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছে্‌ এক লোক আল্লাহর রাসূল -এর খেতে এসে বলল, আমি আপনার নিকট দু’টি বিষয়ের উপর বাইয়াত গ্রহণ করতে এসেছি। একটি হলো, হিজরত। অপরটি হল জিহাদ। অর্থাৎ আমি নিজের মাতৃভূমি ত্যাগ করে হিজরতের উদ্দেশ্যে মদিনায় বসবাস করার ইচ্ছা পোষণ করেছি। আর উদ্দেশ্য হলো, আপনার সাথে জিহাদে শরীক হওয়ার। এর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাওয়াব লাভের আশা করি। রাসূল  তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার পিতা-মাতা কি জীবিত আছেন? লোকটি জানালো, তাঁরা উভয়ই জীবিত আছেন। রাসূল  বললেন, আসলেই কি তুমি সাওয়াব চাও? লোকটি  উত্তর দিল, হ্যাঁ, আমি সাওয়াব চাই। নবীজী  বললেন, তাহলে তুমি মাতা-পিতার কাছে ফিরে যাও এবং তাদের খেদমত করো।

তাদের মুখে হাসি ফুটাওঃ

মূলত হাদীসটিতে জিহাদের ফজিলতকে মাতা-পিতার খেদমতের কাছে বিসর্জন দেওয়া হয়েছে। লোকটিকে মাতা-পিতার খেদমতে ফেরত দেওয়া হয়েছে। এক বর্ণনায় এসেছে, একবার জিহাদের প্রস্তুতি চলছিল। ইত্যবসরে এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ -এর নিকট আরজ করল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি এসেছি জিহাদে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে। লোকটি গৌরবের সঙ্গে আরও জানালো, জিহাদে শরীক হওয়ার তামান্না আমার মাঝে এত বেশী যে, এর জন্য মাতা-পিতার কান্নাকেও উপেক্ষা করেছী। অর্থাৎ আমার মা-বাবা চান না আমি জিহাদে শরীক হই। তাই তাঁরা আমাকে জিহাদের অনুমতি দিচ্ছেন না। তবুও আমি জিহাদের উদ্দেশ্যে চলে এসেছি।  আমার বিরহ-বেদনায় তাঁরা কান্না জুড়ে দিয়েছিলেন। নবীজী  তাকে বললেন,

ارجِع إليهِما فأضْحِكْهُما كما أبكيْتَهُما

ফিরে যাও, তাদের মুখে হাসি ফুটাও। যেমন তাদের কাঁদিয়েছিলে। আমার সঙ্গে তোমার জিহাদে শরীক হওয়ার অনুমতি নেই।

আল্লাহ আমাদেরকে  মা- বাবার সেবা করার তৈফিক দান করুন আমীন।

চোখ রাখুন……

Leave a Reply